লেখকঃ জিরো
টু ইনফিনিটি
‘শূন্য’ । এক বিভীষিকার নাম! ছাত্রজীবনের বিশাল অর্জনের খাতায় এই
সুন্দর সংখ্যাটি কতবার যে জোড়ায় জোড়ায় যুক্ত হয়েছে তার কি হিসেব আছে? মাঝে মাঝে তো মনেই হয়- ‘গণিতবিদেরা কেন যে এই হতভাগা সংখ্যাটি আবিষ্কার
করেছিলেন? তাদের জন্যেই
তো আমাদের এই যন্ত্রণা!’
কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে, আমরা এ জন্যে যতটুকু বিপদে পড়ে গিয়েছি, আমাদের গণিতবিদদের কিন্তু এই শূন্যকে নিয়ে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি কষ্ট করতে হয়েছে। তাঁদের অনেক সাধনা আর পরিশ্রমের পর এই শূন্য আজ সংখ্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত! অর্থাৎ সংখ্যার মর্যাদা পাওয়ার জন্যে ‘০’ কে বিশাল এক পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। আজ আমরা সেই পথেরই কয়েকটি বাঁকের সাথে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করব।
কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে, আমরা এ জন্যে যতটুকু বিপদে পড়ে গিয়েছি, আমাদের গণিতবিদদের কিন্তু এই শূন্যকে নিয়ে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি কষ্ট করতে হয়েছে। তাঁদের অনেক সাধনা আর পরিশ্রমের পর এই শূন্য আজ সংখ্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত! অর্থাৎ সংখ্যার মর্যাদা পাওয়ার জন্যে ‘০’ কে বিশাল এক পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। আজ আমরা সেই পথেরই কয়েকটি বাঁকের সাথে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করব।
তাহলে শুরু হয়ে যাক পথচলার সন্ধান … … …!
“শূন্য আবিষ্কার করেছেন কে?”- এই অমূল্য প্রশ্নের উত্তর সরাসরি দিতে গেলে প্রশ্নকর্তাকে নিরাশ করতে হবে। কেননা এর উত্তর – “নিশ্চিতভাবে বলা যায় না”। এমন তো আর হয়নি যে, কেউ হঠাৎ করে শূন্য আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন, আর এরপর থেকেই সবাই এর ব্যবহার শুরু করেছে। আর এক্ষেত্রেই সেই প্রচলিত কথাটি উল্লেখ করতে হয়, “প্রয়োজনীয়তাই উদ্ভাবনের জনক”। তাই মানুষ তাদের বাস্তব জীবনের কিছু Common Concept ব্যবহার করেই হয়তো শূন্য সম্পর্কিত ধারণা লাভ করেছিল।
প্রাচীনকালের মানুষের চিন্তাধারা যথেষ্ট উন্নত ছিল না। তাই তারা সরাসরি সংখ্যার চিন্তা করত না। তারা তাদের Real Life সম্পর্কিত ঘটনা থেকেই সংখ্যার ধারণা নিত। প্রশ্ন এসেই যায় – কীভাবে?
ধরা যাক, কারও কাছে ৭টা ধনুক আছে। প্রতিটা ধনুককে তারা একটা একক বা Unit কল্পনা করে ৭টা ধনুককে চিহ্নিত করত। আর এখান থেকেই ‘ধনুক’ শব্দটা বাদ দিয়ে কেবল Number বা সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা গ্রহণ করত। আর তারা তাদের সীমিত জ্ঞান নিয়ে বাস্তব জীবনের বাইরের কোনকিছুর চিন্তা করতে পারত না। তাই Negative Number সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল না। কারণ কারও কাছে (-১২) টা ভেড়া কিংবা (-১৯) টা গরু থাকা সম্ভব না। আর ‘শূন্য’ তথা ‘কিছুই না’ নিয়ে তাদের অভিমত ছিল- যার অস্তিত্বই নেই, তাকে নিয়ে মিছেমিছি চিন্তার দরকার কী?
তবে শূন্য কেন দরকার তা ধীরে ধীরে মানুষকে প্রভাবিত করে। গণনার সময় সৃষ্টি হওয়া নানা সমস্যা থেকেই শূন্য এক সময় অস্তিত্বশীল হতে থাকে। এজন্যেই বিভিন্ন সময়ে শূন্যনির্দেশক নানা চিহ্ন ব্যবহৃত হতে দেখি আমরা। এখন আমরা জানি, সাধারণভাবে ‘০’ দুইটি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় –
# স্থানীয় মান সংখ্যা ব্যবস্থায় (Place-value Number System) বিভিন্ন অঙ্কের যথাযথ অবস্থান নিশ্চিত করার জন্যে।
# স্বকীয় সংখ্যা হিসাবে।
প্রথম ক্ষেত্রটিই মূলত মানুষের শূন্য নিয়ে চিন্তা করার প্রধান কারণ ছিল। অর্থাৎ সংখ্যার মাঝে শূন্যস্থান পূরণ করার চিন্তা থেকেই শূন্য নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়।
ধরা যাক, আমরা এখন যেভাবে ১৯০৫ আর ১৯৫ সহজেই পৃথকভাবে লিখি, ‘০’ না থাকলে কি সেইভাবে লেখা সম্ভব হত? তখন তো তাহলে ১৯০৫-কেও ১৯৫ লিখতে হত। আর চাইলে কারও কাছ থেকে ১৯০৫ টাকা ধার নিয়ে ১৯৫ টাকা ফেরত দিলেও চলত!! কিন্তু এটা তো আর সম্ভব না। এজন্যেই বুঝা যাচ্ছে, ‘০’ এর আবির্ভাব কোন উদ্দেশ্য থেকে। (বাস্তব জীবনের সাথে কিন্তু এর সম্পূর্ণ সঙ্গতি আছে! চাইলে নিজে নিজে কিছু উদাহরণ তৈরি করে যে কেউই এই ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখতে পারেন।)
শূন্য নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে অনেকেই অনেক চিন্তা করেছে। তবে প্রাথমিক দিকেই শূন্যের প্রচলন আর বিকাশে ব্যবিলনীয়দের কিছু নমুনার উল্লেখ পাওয়া যায়। অনেকেরই ধারণা, স্থানীয় মান সংখ্যা পদ্ধতি (Place-value Number System) প্রচলনের সাথেই সাথেই প্রয়োজনের তাগিদে শূন্যস্থানজ্ঞাপক হিসেবে শূন্যের আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, ব্যবিলনীয়রা হাজার বছরের বেশি সময় ধরে তাদের নিজস্ব Place-value Number System ব্যবহার করত, যাতে সরাসরি শূন্যের কোন ব্যবহার দেখা যায় না। এখানে প্রসঙ্গত একটি কথা বলে রাখি, ব্যবিলনীয়দের সংখ্যা ব্যবস্থা কিন্তু আমাদের মত ১০-ভিত্তিক ছিল না। তারা ৬০-ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি অনুসরণ করত। আমরা মোটামুটি সবাই জানি যে, মানুষের ২ হাতের ১০ আঙ্গুল দিয়ে গণনার ধারণা থেকেই ১০-ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি (Decimal) আমাদের কাছে সুবিধাজনক মনে হয়। তাহলে একটা প্রশ্ন – “ব্যবিলনীয়দের ২ হাতে কি ৬০টা আঙ্গুল ছিল?” এই আজব প্রশ্নের উত্তর চাইলে ভেবে দেখতে পারেন! [এটার অবশ্যই সুন্দর একটা ব্যাখ্যা আছে!]
আবার মূল কথায় ফিরে আসি। ব্যবিলনীয়রা ‘০’ ছাড়া অনেকদিন সংখ্যা ব্যবস্থা ব্যবহার করলেও 400 BC এর দিকে গণনার সুবিধার জন্যেই ‘০’ (বা শূন্যজাতীয় কিছু একটা) ব্যবহার করতে থাকে। ওই যে, ১৯০৫ আর ১৯৫ এর কথা একটু আগেই বলা হয়েছিল, ওই ক্ষেত্রে তারা কী ব্যবহার করত তাহলে? আমরা এখন যেখানে শূন্য লিখছি, তারা সেখানে দু’টি ছোট তীর্যক চিহ্ন ব্যবহার করত। এখানে বলে দেওয়া উচিত, আমরা যেমন ১,২,৩ …. ইত্যাদি অঙ্ক ব্যবহার করি, তাদের কিন্তু এগুলোও ছিল না। তারা Y-এর মত দেখতে ১ আর কোণাকৃতি চিহ্নের ন্যায় ১০ ব্যবহার করত।
তবে এখানে যে সীমাবদ্ধতা রয়েই যায়, তা হল- শূন্যকে তারা কেবল শূন্যস্থান বুঝাতেই ব্যবহার করেছে। এর অর্থ এই চিহ্ন দ্বারা ওই স্থানে অন্য কোন অঙ্কের বসার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেওয়া হত।
এছাড়াও মেসোপটেমিয়ার কিশ নগরে পাওয়া 700 BC এর আবিষ্কৃত মাটির ফলকে Bel-ban-Aplu নামের এক লেখককে ‘Empty Place’ বুঝাতে তিনটি হুক চিহ্ন ব্যবহার করতে দেখা যায়। আবার প্রায় একই সময়ে একটি হুক চিহ্নের ব্যবহারেরও প্রমাণ পাওয়া যায়। অর্থাৎ তারা নিশ্চিতভাবে কোন সার্বজনীন চিহ্ন/প্রতীক ব্যবহার করতে পারেনি। এর বাইরেও একটা ফাঁক রয়ে যায়। তারা এই চিহ্নগুলি কেবল একাধিক Digit এর মাঝে ব্যবহার করত, কখনোই সংখ্যার ডানে নয়। তাহলে তারা ৫০০, ৫০ কিংবা ৫ এর মাঝে পার্থক্য করত কীভাবে?
এটা বুঝার জন্যে আবার সেই Real life problems-এ ফিরে যেতে হয়! ধরা যাক, কেউ ২ টা ক্যান্ডির দাম বলল ৫, আর একটা টি-শার্টের দাম বলল ৫। তাহলে সাধারণভাবে ঠিকই বুঝে নেওয়া যায় যে, ক্যান্ডি দুইটার দাম ৫ টাকা, আর টি-শার্টটার দাম ৫০০ টাকা। এজন্যেই তাদের এই বিষয়ে সমস্যায় পড়তে হয়নি।
মিশরীয়রা কিন্তু ১০ ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতিই ব্যবহার করত, যদিও তার সাথে আমাদের পদ্ধতির সাদৃশ্য ছিল না। তারা স্থানীয় মান পদ্ধতি নয়, বরং পৃথক পৃথক প্রতীক দিয়ে বিরাট বিরাট সংখ্যা প্রকাশ করত। মিশরীয়য়া ন-ফ-র (nfr) নামে একটি চিহ্ন গণনার সময় ব্যবহার করত, যা সম্ভবত তাদের শূন্যকেই প্রকাশ করে।
এরপর সংখ্যার মর্যাদা পাওয়ার আশায় শূন্যের পথচলা শুরু হল গ্রীকদের কাছে। এখানে আরও আজব ব্যাপার! এদের কোন স্থানীয় মান পদ্ধতিই ছিল না! এরপরও কিন্তু গ্রীকরা সংখ্যা নিয়ে অনেক কাজ করেছে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা শূন্য নিয়ে তেমন চিন্তাই করেনি। এর পেছনে আরও একটা কারণ হল- গ্রীক গণিতবিদেরা জ্যামিতির উৎকর্ষ সাধনে বেশি মগ্ন ছিলেন। আর গণনার কাজে যে সংখ্যা ব্যবহৃত হত, তাকেও অনেক ক্ষেত্রে তারা রেখার দৈর্ঘ্য (Lengths of lines) হিসেবেই প্রকাশ করত। গ্রীকরা আসলেই দুর্ভাগা! কেননা এই ‘রেখার দৈর্ঘ্য’ চিন্তাটাকেই আরেকটু বিস্তৃত করতে পারলেই কিন্তু Zero আর Negative Number নিয়ে তারা অনেক বড় অবদান রাখতে পারত।
যাই হোক! গ্রীকরা যে শূন্য নিয়ে একেবারেই কাজ করেনি, তা কিন্তু নয়। বিশেষত জ্যোতির্বিজ্ঞানের নানা হিসাবরক্ষণের সময় ঠিকই শূন্যের দরকার পড়ল। তখন তারা যে চিহ্ন ব্যবহার করল তা হল – ‘O’। তারা কেন এটি ব্যবহার করল তা নিয়েও তর্ক বিতর্ক আছে। ‘কিছুই না’ এর গ্রীক শব্দ ‘Ouden’ এর প্রথম বর্ণ হচ্ছে O (Omicron). এজন্যেই এই চিহ্ন ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু Omicron দিয়ে যে আবার তারা 70 সংখ্যাটিকেই প্রকাশ করত! তাহলে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়ে যায় না? তাই অনেকেই মনে করেন, ‘O’ দিয়ে ‘Obol’ বুঝানো হত, যা একেবারেই স্বল্পমানের (almost zero) একটি মুদ্রা ছিল। যুক্তি যাই হোক, আমরা কিন্তু এখন এটার প্রায় অনুরূপ চিহ্নই ব্যবহার করছি।
এতক্ষণ যা বলা হল তা থেকে একটা ব্যাপার কিন্তু সহজেই বুঝে নেওয়া যায় যে, প্রাথমিক অবস্থা থেকেই কোন সংখ্যার ‘Correct interpretation’ এর জন্যে অনেকটা ‘Punctuation mark’ হিসেবে Zero ব্যবহার করা হয়েছে। কেউই একে স্বতন্ত্র সংখ্যা হিসেবে তখনো মর্যাদা দেয়নি (কিংবা চিন্তাও করতে পারেনি!)। আর তাদের সংখ্যা ব্যবস্থাগুলোও ছিল কিছুটা জটিল বা গণনার জন্যে কষ্টসাধ্য।
তবে মধ্য-আমেরিকান মায়ানরা (Mayan) ২০-ভিত্তিক একটি চমৎকার সংখ্যা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তারা কেবল তিনটি অঙ্ক (ঝিনুকের খোলের মত শূন্য, বিন্দুর ন্যায় এক, পাঁচজ্ঞাপক ক্ষুদ্র রেখাংশ) ব্যবহার করে অনেক বড় বড় সংখ্যা লিখতে পারত। কিন্তু Mayan সভ্যতা ৯ম শতাব্দীতে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর এগুলো নিয়ে আর বিশেষ কোন কাজ হয়নি।
এরপর শূন্যের ধারণা নিয়ে যত অগ্রগতি হয়েছে তার অঙ্কখানি অবদান এই উপমহাদেশের গণিতবিদদেরই। এখানে 300 BC এর দিকে ব্রাহ্মী (Brahmi) নামে একটা সংখ্যাব্যবস্থার প্রচলন হয়। যদিও তা বর্তমানের স্থানীয় মান পদ্ধতির ন্যায় নয়। এজন্যে সংখ্যা প্রকাশক চিহ্নও ছিল অনেক বেশি। ৬ষ্ঠ শতকে ভারতে প্রথম কার্যকর ১০-ভিত্তিক সংখ্যা ব্যবস্থা প্রচলিত হয়, যার মূল অবদান বিখ্যাত পণ্ডিত আর্যভটের (476-550 AC)। তবে তিনি তাঁর কাজে প্রচলিত ব্রাহ্মীলিপি ব্যবহার না করে নিজস্ব ‘বর্ণমালা পদ্ধতি’ অনুসরণ করেন। তবে তাঁর দশমিক সংখ্যা ব্যবস্থায় শূন্য কেবল শূন্যস্থানজ্ঞাপক হিসেবেই ছিল কিনা, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে। যদিও জর্জেস ইফ্রাহ (Georges Ifrah) এর অভিমত অনুযায়ী – আর্যভট পরোক্ষভাবে সেটিকে একটি দশমিক অঙ্ক হিসেবেই ব্যবহার করতেন। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তাঁর এই প্রচেষ্টার কারণেই পরবর্তীতে উপমহাদেশে শূন্য নিয়ে অনেক চর্চা হয়।
আর্যভটের পর ব্রহ্মগুপ্ত (598-670 AC) শূন্য নিয়ে কাজ করেন। তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘ব্রহ্মস্ফূটাসিদ্ধান্ত’
(628 AC) বইতে বিভিন্ন গাণিতিক ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, বিবৃতি তুলে ধরেন। ব্রহ্মগুপ্তই শূন্যকে প্রথমবারের মত সংখ্যার মর্যাদা দেন। তবে তিনি এই সম্পর্কে কোন সার্বজনীন-গ্রহণযোগ্য যুক্তি প্রদান করেননি। আর তাঁর ধারণাগুলোকেও বিস্তৃত করে প্রকাশ করেননি। কিন্তু তিনি তাঁর বইতে ‘০’ সম্পর্কিত যোগ, বিয়োগ, গুণ – এর ফলাফল সফলভাবে তুলে ধরেন। এজন্যে তাকে ‘শূন্যের আবিষ্কারক’-এর মর্যাদাও দেওয়া হয়। এরপর গণিতবিদ ভাস্করও শূন্য নিয়ে মূল্যবান কাজ করেছেন।
শূন্য ভারতীয়দের হাত ধরেই মুসলিমদের কাছে যায়। বাগদাদের খলিফা আল-মনসুরের রাজসভায় ভারতীয় জ্যোতির্বিদ কঙ্কার আগমন ঘটেছিল। তিনি খলিফাকে উপহার হিসেবে ব্রহ্মগুপ্তের বই প্রদান করেন, যা বাইতুল হিকমাতে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। ৯ম শতকের শুরুর দিকে বাগদাদের খলিফা আল-মামুন তাঁর রাজসভায় আমন্ত্রিত করেন সংখ্যাপ্রেমী এক জ্ঞানী যুবককে, যার নাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে মুসা (মুসা আল খোয়ারিজমি)। তিনি ব্রহ্মগুপ্তের বইয়ের সান্নিধ্যে এসেই ‘ব্রাহ্মী’ লিপির সন্ধান লাভ করেন।
ভারতীয় এই সংখ্যাপদ্ধতিতে মুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়ে আল খোয়ারিজমি নতুন করে কাজ শুরু করেন। তিনি যোজন কোণের ভিত্তিতে 1,2,3,4 চিত্রিত করেন। এরপর বৃত্তকে ব্যবচ্ছেদ করে যোজন কোণকে এর সাথে সমন্বিত করে অঙ্কিত করেন 5,6,7,8,9-কে। আর সবশেষে শূন্যস্থানের প্রতীক ‘0’-কে অন্তর্ভুক্ত করে ১০-ভিত্তিক সংখ্যালিপিকে পরিপূর্ণতা দান করেন। শূন্যস্থানকে আরবরা সিফর (Sifr) বলত, আর এই Sifr থেকেই ইংরেজি ‘Zero’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছিল।
তবুও জ্ঞানপিপাসু খোয়ারিজমির কাছে মনে হতে থাকে, এই সংখ্যালিপির Sifr-এ অসঙ্গতি রয়ে গিয়েছে। নতুন করে তাঁর মনে প্রশ্নের উদয় হয় – শূন্য কি কেবল শূন্যস্থানকে নির্দেশ করার জন্যেই? এই প্রশ্নের যথার্থ উত্তর পাওয়ার জন্যে তিনি আবার সাধনায় ব্রতী হন। এরপর দীর্ঘ ১৫ বছরের সাধনা আর চিন্তার পর তিনি বুঝতে পারেন, “Sifr শুধু শূন্যতাজ্ঞাপক একটি চিহ্নই নয়, বরং এটি স্বকীয় সংখ্যা যা অসীমের পথে ধাবমান ধনাত্মক আর ঋণাত্মক সংখ্যাকে পৃথক করে ভারসাম্য রক্ষা করছে”। তাঁর এই যুগান্তকারী অনুধাবন মানুষকে অনেকখানি সামনে এগিয়ে দিলেও অনেকেই এটাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। খোয়ারিজমি এর বিরোধিতাকারীদের প্রমাণ করে দেখিয়ে দেন যে, Sifr একটি স্বতন্ত্র সংখ্যা।
এরপর তাঁর এই অনন্য সংখ্যালিপি ধীরে ধীরে বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। লিউনার্দো ফিবোনাচ্চি (Leonardo Fibonacci) যখন এই সংখ্যালিপি ইউরোপে নিয়ে যান, তখন কেউই এটাকে গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। এতকাল ধরে সবাই যাকে অস্তিত্বহীন জানত, কী করে তা পরিপূর্ণ একটি সংখ্যা হিসেবে অস্তিত্বশীল হতে পারে? এই ভ্রান্তির কারণেই অনেকে একে ঘৃণাভরে অবজ্ঞা করেছে। একে সামান্যতম মূল্য দেওয়ার চেষ্টাও করেনি।
কিন্তু সত্য নির্মল-সুন্দর! তাকে দূরে ঠেলে রাখা যায় ক’দিন? আর যে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে এতো দীর্ঘ পথের সাধনা করতে হয়েছে, তা তো আরও মহান! আর এ জন্যেই এক সময় সবার ভ্রান্তি দূর হয়ে যায়। গণিতবিদেরা শূন্য ছাড়া পথ চলতে গিয়ে যখন নানা প্রতিবন্ধকতা আর সমস্যায় পড়লেন, ঠিকই তখন শূন্যকে তাঁরা গ্রহণ করে নিলেন। শূন্যের মাহাত্ম্য আর কারোই অগোচরে রইল না। সকল প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ১৬০০ সালের দিক থেকেই সারা বিশ্বে সাধারণভাবে প্রচলিত হয়ে পড়ল এই সুন্দর সংখ্যা ‘০’ ।
সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেই ‘০’ আজ প্রতিষ্ঠিত! আর কোন সংখ্যাকে এতো বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে হয়নি সংখ্যা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্যে। এজন্যেই তো ‘০’ এতো মহান! তাই এখন থেকে পরীক্ষায় শূন্য পেলেও কারও মন খারাপ করা উচিত না !!! কয়জনের ভাগ্যে এই মহান সংখ্যাপ্রাপ্তি ঘটে, যার জন্যে এতো সাধনার সুদীর্ঘ পথচলা!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন