মঙ্গলবার, জুন ২৫, ২০১৩

দুঁদে ড্রাফটসম্যান থেকে কীভাবে দেবতা হয়ে উঠলেন বিশ্বকর্মা – লিখেছেন নাস্তিক তীর্থযাত্রী

হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মশাস্ত্র বেদে মাত্র তেত্রিশটি দেবতার উল্লেখ থাকলেও হিন্দুরা বিশ্বাস করেন তাদের দেবতা তেত্রিশ কোটি অবশ্য বেশির ভাগ দেবতা স্বর্গে বাস করলেও বেশ কিছু দেবতা এই ধরাধামেই বসবাস করতেন বলে কেউ কেউ মনে করেন এদেরই একজন দলিত গোষ্ঠীভুক্ত দেবতা বিশ্বকর্মা তথা বিশ্বকর্মা ঠাকুর ইনার জন্য সারা বছরে একদিন মাত্র নির্ধারণ করেছেন শ্রমজীবী ভক্তেরা ইনি নিরুপদ্রব দেবতা ইনি ক্রোধী নন, বদমেজাজি ননইনি পুজো পাওয়ার জন্য সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে বাঁশ নিয়ে দৌড়ে বেড়াননি ইনাকে ভয় পেয়ে সাধারণ মানুষ তটস্থ হয়ে থাকেন না ইনিও কার্তিক ঠাকুরের মতো ঘরের ছেলে ভাদ্র মাসের ৩১ তারিখে ইনি পূজিত হন আগের আষাঢ়-শ্রাবণ মাসটা তুমূল বর্যাকাল সময় কোনো কার্য নির্মাণ করা যায় না ভাদ্র-আশ্বিন মাসে সমস্ত মানুষের হাতে প্রচুর টাকাপয়সা আসে, সেইসঙ্গে বৃষ্টি-বাদলার উৎপাতও নেই অতএব নির্মাণশিল্পের স্রষ্টা তথা গুরু বিশ্বকর্মাকে স্মরণ করে ঝাঁপিয়ে পড়ো কর্মযজ্ঞে সমগ্র ভারতবর্ষে নয়, বিশ্বকর্মা পুজো মূলত  অসম, পশ্চিমবঙ্গ, রাজস্থান, উত্তরাখণ্ড (দেরাদুন)-এর কিছু কিছু অঞ্চলে পালিত হয় ভারতবর্ষের বিশ্বকর্মা একটি দলিত সম্প্রদায়ের নাম, বিশ্বকর্মা সেই সম্প্রদায়ের আদিম-সভ্য পুরুষ।। বিশ্বকর্মা পিছিয়ে-পড়া এক জনজাতির ঐতিহাসিক এবং অপ্রতিরোধ্য প্রতিভার বিরল দৃষ্টান্তবিশেষ বিশ্বকর্মা সম্প্রদায়ের মধ্যে পাঁচটি গ্রুপ বর্তমানে তাদের রক্ষাকর্তা ঈশ্বরের স্মৃতিচারণা একটি সুপ্রসন্ন দিন হিসাবে এই উদযাপন করে ৩১ ভাদ্র বিশ্বকর্মা আসলে মানুষের সভ্যতার বিবর্তনের সুদক্ষ পূর্বপুরুষ ৩১ ভাদ্র আসলে সুদক্ষ স্থাপত্যশিল্পী বিশ্বকর্মার জন্মদিবস হিসাবে পালিত হয় পুজোর ছলে এই শূদ্রদেবতার কাছে উত্তরপুরুষ হিসাবে আমরা সারা পৃথিবীর মানুষ কৃতজ্ঞ নিশ্চয়
এহেন এক দেবতাকে আমরা একবার দেখে নেব পুরাণ গ্রন্হগুলিতে কীভাবে উল্লেখ রেখেছে কেন-না পুরাণগ্রন্থগুলি তো আসলে দেবতা তৈরির নির্মাণশালা Craftsmen এবং স্থাপত্যবিদের প্রিজাইডিং দেবতা বিশ্বকর্মা হলেন ব্রহ্মার পুত্র, তিনি সমগ্র মহাবিশ্বের ঐশ্বরিক Draftsman মহাভারত তাকে বর্ণনা করেছে "শিল্পকলা, এক হাজার হস্তশিল্পের Executor বিশ্বকর্মা ছুতোর, কারিগর, সমস্ত স্বর্ণকার(অলংকার নির্মাতা), দরজি অধিকাংশ শ্রমজীবীদের বিশিষ্ট দেবতা" হিসাবে তিনি বলেন, চার হাত আছে, একটি মুকুট পরেন, স্বর্ণের জুয়েলারিতে সজ্জিত থাকেন এবং তার হাতে একটি জলমুচি, একটি বই, একটি noose এবং ঝুলিতে কারিগরের সরঞ্জাম বিশ্বকর্মা পূজানুষ্ঠান অনুষ্ঠান সাধারণত কারখানা প্রাঙ্গনে বা দোকান মেঝে মধ্যে সঞ্চালিত হয়ে থাকে
হিন্দু পুরাণে বিশ্বকর্মার অনেক স্থাপত্য পূর্ণ বিস্ময়ের চার যুগ ব্যাপী তিনি বেশ কয়েকটি শহর ও প্রাসাদের নির্মাতা ছিলেন সত্যযুগে তিনি স্বর্গলোক, যেখানে প্রভু ইন্দ্রর বাসভূমি নির্মিত হয়েছে বিশ্বকর্মা তারপর ত্রেতাযুগে সোনার লঙ্কা, দ্বাপরযুগে দ্বারকা শহর এবং কলিযুগে হস্তিনাপুর এবং ইন্দ্রপ্রস্থ নির্মাণ করেছেন
গোল্ডেন লঙ্কা নির্মাণ পিছনে একটি গল্প আছে কপর্দী পার্বতী বিয়ে করেন, তখন তিনি তাদের বসবাসে জন্য সুন্দর প্রাসাদ নির্মাণ করবেন বলে বিশ্বকর্মার শরণাপন্ন হলেন  বিশ্বকর্মা কনক একটি প্রাসাদ নির্মাণ করলে গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য শিব লঙ্কার অধীপতি রাবণকে আমন্ত্রণ জানালেন পবিত্র অনুষ্ঠান করার পরে শিব দক্ষিণা হিসাবে রাবণকে স্বর্ণনির্মিত প্রাসাদটি উপহার দেন শিবের ইচ্ছানুসারেই গোল্ডেন লঙ্কা রাবণের প্রাসাদে পরিণত হয়
দ্বারকা বিশ্বকর্মার নির্মিত অনেক শহরগুলির মধ্যে একটি
মহাভারতের চরম কূটনীতিক শ্রীকৃষ্ণের রাজধানী দ্বারকা শহর মহাভারতের সময় কৃষ্ণ দ্বারকায় বসবাস করেছেন, এবং বলা হয় এটা তার কর্মফল ভূমিবা অপারেশন কেন্দ্র সেজন্য উত্তর ভারতের এই জায়গা হিন্দুদের জন্য একটি সুপরিচিত তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে
বিশ্বকর্মা যে শুধু কর্মে সুদক্ষ তা নয়, তিনি বেশ কিছু গ্রন্থও লিখে রেখে গেছেন উত্তরসূরীদের জন্য এবার আলোচনা করব বিশ্বকর্মার লেখক-প্রতিভা এবং লেখালেখি বিষয়ে বিশ্বকর্মার রচিত স্থাপত্যশিল্প বিষয়ক গ্রন্থটির নামবাস্তুশাস্ত্রম মানসারএবংময়মতমগ্রন্থে বস্তু বাস্তু শব্দদুটিকে সমার্থক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছেবস্তুশব্দ থেকেবাস্তুকথাটা এসেছেবাস্তুশব্দের অর্থ পৃথিবী ব্যাপক অর্থে সমস্ত প্রাণীর আবাসস্থলই বাস্তু অর্থাৎ, স্রষ্টার যে-কোনো সৃষ্টিই বাস্তু কাজেই শুধু পরিকল্পিত মনুষ্যগৃহই নয়, দেবতা থেকে শুরু করে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর আবাসকেই বাস্তু বলে বাস্তুশাস্ত্রে বাস্তু শব্দের অর্থ ব্যাপক এই শিল্পকে নির্মাণ শিল্পকে না-বুঝিয়ে পরিকল্পনা, নির্মাণ, চিত্র, অলংকরণ, স্বর্ণ-চর্ম-বয়নশিল্প, অস্ত্রশিল্প, পোতনির্মাণ, মূর্তিনির্মাণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত আছে
পুরাণে উল্লেখ আছে, চারটি বেদের মতো চারটি উপবেদও আছে উপবেদগুলি হল আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গান্ধর্ববেদ এবং স্থাপত্যবেদ এই উপবেদ স্থাপত্যবিদ্যা বা বাস্তুবিদ্যার রচয়িতা হলেন বিশ্বকর্মা বলা হয় তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রধান বাস্তুকার তাঁর রচিত অন্তত দশখানি পুথি পর্যন্ত পাওয়া গেছে অন্যদিকে মৎস্যপুরাণের ২৪২ থেকে ২৪৭ অধ্যায়, অগ্নিপুরাণের ১০৪ থেকে ১০৬ অধ্যায়, গরুড়পুরাণের ৪৬ থেকে ৪৭ অধ্যায়, ভবিষ্যপুরাণ, বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণের তৃতীয় খণ্ড, বিভিন্ন আগম, শুক্রনীতিসারের চতুর্থ অধ্যায়, বৃহসংহিতা, গৃহ্যসূত্র, অর্থশাস্ত্র প্রভৃতিতে বাস্তুশাস্ত্রের আলোচনা পাই ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় গণপতিশাস্ত্রী বাস্তুবিদ্যা বা বাস্তুশাস্ত্রম গ্রন্থটি আবিষ্কার করে মুদ্রিত করেন বিশ্বকর্মার নামে প্রচলিত বাস্তুশাস্ত্রটির নামবিশ্বকর্মাবাস্তুশাস্ত্রম আর্যাবর্তের শিল্পধারা বিশ্বকর্মার দ্বারা প্রবর্তিত বলে মনে করা হয় বিশ্বকর্মারবাস্তুশাস্ত্রম”-এর প্রথমেই বলা হয়েছে, জগতের কল্যান কামনায় এই শাস্ত্র প্রচার করছেনবাস্তুশাস্ত্রং প্রবক্ষ্যামি লোকানাং হিতকাম্যয়া বিশ্বকর্মার নামে এরকম গ্রন্থ অন্ততপক্ষে দশটি পাওয়া গেছে
কী আছেবাস্তুশাস্ত্রমগ্রন্থটিতে ? সুপরিকল্পিতভাবে গৃহনির্মাণ, গ্রাম ও নগরের পত্তনের নিয়মাবলি এবং বিধিনিষেধ তাঁর গ্রন্থটিতে পাওয়া যায়
বিশ্বকর্মা রচিত এই গ্রন্থে গৃহ, মন্দির, গ্রাম, নগর, যন্ত্র প্রভৃতির বর্ণনা দেখতে পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের প্রধান আলোচ্য বিষয় হল – (১) সর্বপ্রথম গৃহারম্ভের কাল পরীক্ষা, উপকরণ সংগ্রহ, জমি পরীক্ষা, বিভিন্ন দিক নির্ণয়, ভবন লক্ষণ প্রভৃতি বিভিন্ন পরিচ্ছেদে আলোচিত হয়েছে। (২) বাসযোগ্য গৃহ ছাড়াও বিদ্যালয়, চিকিৎসালয়, সর্বসাধারণের ব্যবহার্য গৃহ, পাকশালা, শৌচাগার, পুষ্করিণী, উদ্যান প্রভৃতি কোনদিকে থাকবে, আলো-বাতাস প্রবেশের কীরকম হবে, সবই সুন্দরভাবে আলোচিত হয়েছে। (৩) বিশ্বকর্মার খ্যাতি পুরাণাদিতে দেবশিল্পী হিসাবে পাওয়া যায়। বিভিন্ন মন্দির ও তার উপকরণ প্রভৃতির বিস্তৃত আলোচিত হয়েছে। মন্দিরের কাজে ব্যবহারের জন্য আট প্রকার কাঠ এবং সাধারণ গৃহস্থদের গৃহনির্মাণের জন্য তেইশ প্রকারের কাঠের ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। কাঠগুলি কাটার পর পনেরো দিন জলের মধ্যে ভিজিয়ে রাখলে তাতে পোকা ধরবে না। এই প্রসঙ্গে বিশ্বকর্মা লিখেছেন – “কাষ্ঠং নো ভক্ষ্যতে কীটের্যদি পক্ষং ধৃতং জলে”।(৪) দেওয়ালের প্রস্থ ও উচ্চতা, ভিতের গভীরতা, দরজা ও জানালার পৃথক পৃথক মাপের বর্ণনাও এই গ্রন্থটিতে পাওয়া যায়।
ভারতীয় স্থাপত্যশিল্পের ইতিহাসে বিশ্বকর্মার “বাস্তুশাস্ত্রম” গ্রন্থটির অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। ইতিহাসের উপাদান হিসাবে “বাস্তুশাস্ত্রম” এক অমূল্য সম্পদ।

কোন মন্তব্য নেই: